অন্য একটি কারণে ‘আশূরা’ মুসলিম উম্মাহর মধ্যে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে, তা হলো কারবালার ঘটনা।

 


অনেকে ‘আশূরা’ বলতে কারবালার ঘটনাই বুঝেন, যদিও ইসলামী শরীয়তে আশূরার সিয়াম বা ফযীলতের সাথে কারবালার ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে ঐতিহাসিক ঘটনা হিসাবে কারবালার ঘটনা পর্যালোচনা করা আমাদের জন্য অতীব প্রয়োজন। উম্মাতের জন্য এ ঘটনা ছিল অত্যন্ত হৃদয় বিদারক বেদনাদায়ক ঘটনা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওফাতের মাত্র ৫০ বৎসর পরে ৬১ হিজরী সালের মুহাররাম মাসের ১০ তারিখ শুক্রবার ইরাকের কারবালা নামক স্থানে তাঁরই উম্মাতের কিছু মানুষের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন তাঁরই প্রিয়তম দৌহিত্র হযরত হুসাইন ইবনু আলী (রা)। এ ঘটনা মুসলিম উম্মাহর মধ্যে চিরস্থায়ী বিভক্তি ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। অনেক মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কাহিনী এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মুসলিম উম্মার মধ্যে ছড়ানো হয়েছে। যেগুলির বিস্তারিত আলোচনা এ খুতবার পরিসরে সম্ভব নয়। এখানে আমরা নির্ভরযোগ্য প্রাচীন ইতিহাসগ্রন্থের আলোকে ইমাম হুসাইনের শাহাদতের ঘটনা সংক্ষেপে আলোচনা করব। তার আগে আমরা এর প্রেক্ষাপট বুঝতে চেষ্টা করব।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আগমনের সময় সমগ্র বিশ্বের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ছিল মূলত বংশতান্ত্রিক। রাষ্ট্রের মালিক রাজা। তার অন্যান্য সম্পদের মতই রাষ্ট্রের মালিকানাও লাভ করবে তার বংশধরেরা। রাজ্যের সকল সম্পদ-এর মত জনগণও রাজার মালিকানাধীন। রাজা নির্বাচন বা রাজ্যপরিচালনা বিষয়ে তাদের কোনো মতামত প্রকাশের সুযোগ বা অধিকার নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বপ্রথম একটি আধুনিক জনগণতান্ত্রিক পরামর্শ-ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এ ব্যবস্থার দুটি বিশেষ দিক ছিল: (১) রাজা ও প্রজার সম্পর্ক মালিক ও অধীনস্থের নয়, বরং মালিক ও ম্যানেজারের। তবে মালিক রাজা নন। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। রাজা তাদের খলীফা বা প্রতিনিধি বা ম্যানেজার হিসেবে তা পরিচালনা করবেন। জনগণই তাকে মনোনিত করবেন এবং জনগণ তাকে সংশোধন বা অপসারন করবেন। (২) রাষ্ট্রপ্রধান নির্ধারণ করা একটি জাগতিক কর্ম এবং তা জনগণের কর্ম। জনগণের পরামর্শের ভিত্তিতে তা সম্পন্ন হবে। পরামর্শের ধরন নির্ধারিত নয়। যুগ, দেশ ও জাতির অবস্থা অনুসারে তা পরিবর্তিত হতে পারে।
এ ব্যবস্থার আওতায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাউকে মনোনিত না করে উম্মাতকে সরাসরি নির্বাচনের মুখোমুখি রেখে যান। আবূ বকর (রা) নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শক্রমে উমারকে (রা) পরবর্তী শাসক হিসেবে মনোনয়ন দিয়ে যান। উমার (রা) ৬ জনের একটি কমিটিকে মনোনয়ন দেন, যারা জনগণের পরামর্শের ভিত্তিতে তাঁদের মধ্য থেকে উসমানকে (রা) মনোনয়ন দেন। উসমান (রা)-এর শাহাদতের পরে মদীনার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ পরামর্শের মাধ্যমে আলী (রা)-কে শাসক মনোনিত করেন। আলী (রা) তাঁর ইন্তেকালের পূর্বে তাঁর পুত্র হাসান (রা)-কে পরবর্তী শাসক হিসেবে মনোনয়ন দেন।
৪০ হিজরীর রামাদান মাসে আলীর (রা) ওফাতের পর হাসান (রা) খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। গৃহযুদ্ধ বন্ধ করার জন্য ৬ মাস পরে তিনি মুআবিয়ার (রা) পক্ষে খিলাফতের দায়িত্ব পরিত্যাগ করেন এবং মুআবিয়া (রা) সর্বসম্মতভাবে খলীফা হন। ২০ বৎসর সুষ্ঠ রাষ্ট্রপরিচালনার পর ৬০ হিজরী সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পূর্বে রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দের পরামর্শক্রমে তিনি তাঁর পুত্র ইয়াযিদকে পরবর্তী শাসক হিসেবে মনোনয়ন দেন। তাঁর মৃত্যুর পরে ইয়াযিদ খিলাফতের দায়িত্ব দাবি করলে তৎকালীন মুসলিম রাষ্ট্রের অধিকাংশ এলাকার মানুষ তা মেনে নেন। পক্ষান্তরে মদীনার অনেক মানুষ, ইরাকের মানুষ এবং বিশেষত কুফার মানুষেরা তা মানতে অস্বীকার করেন।
কুফার মানুষেরা আলীর (রা) দ্বিতীয় পুত্র ইমাম হুসাইনকে (রা) খলীফা হিসেবে গ্রহণ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। এ সময়ে ইমাম হুসাইন (রা) মদীনায় অবস্থান করছিলেন। এরপর তিনি মদীনা থেকে মক্কায় আগমন করেন। কুফার লক্ষাধিক মানুষ তাঁকে খলীফা হিসাবে বাইয়াত করে পত্র প্রেরণ করে। তারা দাবি করে যে, সুন্নাত পুনরুজ্জীবিত করতে ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে অবিলম্বে তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করা প্রয়োজন। মদীনা ও মক্কায় অবস্থানরত সাহাবীগণ ও ইমাম হুসাইনের প্রিয়জনেরা তাকে কুফায় যেতে নিষেধ করেন। তাঁরা আশঙ্কা করছিলেন যে, ইয়াযিদের পক্ষ থেকে বাধা আসলে ইরাকবাসীরা হুসাইনের পিছন থেকে সরে যাবে। সবশেষে হুসাইন (রা) কুফা গমনের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তাঁর পরিবারের ১৯ জন সদস্যসহ প্রায় ৫০ জন সঙ্গী নিয়ে কুফায় রওয়ানা হন।
ইয়াযিদের নিকট এ খবর পৌঁছালে তিনি কুফার গভর্নর নু’মান ইবনু বাশীর (রা)-কে পদচ্যুত করে বসরার গভর্নর উবাইদুল্লাহ ইবনু যিয়াদকে কুফার দায়িত্ব প্রদান করেন। তিনি তাকে নির্দেশ দেন অবিলম্বে কুফায় যেয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করতে এবং হুসাইন যেন কুফায় প্রবেশ করতে না পারেন সে ব্যবস্থা করতে। উবাইদুল্লাহ কুফায় পৌঁছে কঠোর হস্তে কুফাবাসীকে দমন করে। এরপর ৪ হাজার যোদ্ধার এক বাহিনী প্রেরণ করে হুসাইনকে (রা) প্রতিরোধ করতে। উবাইদুল্লাহর বাহিনী হুসাইনকে কারবালার প্রান্তরে অবরোধ করে। হুসাইন (রা) তাদেরকে বলেন, আমি তো যুদ্ধ করতে আসি নি। তোমরা আমাকে ডেকেছ বলেই আমি এসেছি। এখন তোমরা কুফাবাসীরাই তোমাদের বাইয়াত ও প্রতিজ্ঞা পরিত্যাগ করেছ। তাহলে আমাদেরকে ছেড়ে দাও আমরা মদীনায় ফিরে যাই, অথবা সীমান্তে যেয়ে কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি, অথবা সরাসরি ইয়াযিদের কাছে যেয়ে তার সাথে বুঝাপড়া করি।
উবাইদুল্লাহ প্রথমে প্রস্তাব মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু শিমার নামক তার এক সহচর বলে, যদি হুসাইনকে বাগে পেয়েও তুমি তাকে হত্যা না করে ছেড়ে দাও তবে তোমার পদোন্নতির সব সুযোগ শেষ হয়ে যাবে। তখন সে হুসাইন (রা)-এর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এবং তাকে হত্যার নির্দেশ দেয়।
আশূরার দিন সকাল থেকে উবাইদুল্লাহর বাহিনী হুসাইনের সাথীদের উপর আক্রমন চালাতে থাকে। পার্শবর্তী নদী থেকে পানি গ্রহণে তারা তাঁদেরকে বাধা দেয়। তাদের আক্রমনে তাঁর পরিবারে দুগ্ধপোষ্য শিশু, কিশোর ও মহিলাসহ অনেকে নিহত হন। হুসাইন তাঁর পুরুষ সাথীদের নিয়ে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করতে থাকেন। পর্যায়ক্রমে তাঁর সাথীরা সকলেই নিহত হন। তিনি বীর বিক্রমে যুদ্ধ করতে থাকেন। এক পর্যায়ে সিনান নাখয়ী নামক এক ইয়াযিদ-সৈনিক তাকে আঘাত করলে তিনি মাটিতে পড়ে যান। তখন সিনান নিজে বা খাওলী নামক অন্য এক সৈন্য বা শিমার তাঁকে আঘাত করে তাঁর মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাকে শহীদ করে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।-------------চলবে
খুতবাতুল ইসলাম
ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহিমাহুল্লাহ।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন