সমাজের প্রচলিত ভুল ও কুসংস্কার

বিয়ের পরে মেয়েরা চুড়ি বা নাকফুল না পরলে কি স্বামীর হায়াত কমে যায়?কোনো কোনো এলাকার মানুষকে বলতে শোনা যায়, বিয়ের পর স্ত্রী চুড়ি বা নাকফুল না পরলে স্বামীর হায়াত কমে যায়। এটি একেবারেই মনগড়া ও ভিত্তিহীন একটি ধারণা, একটি কুসংস্কার; এগুলো বিশ্বাস করা যাবে না।

নাক কান ফুঁড়ানো বয়দো কিন্তু কুসংস্কারে বিশ্বাস করা ঠিকনা
কান ও তার অলঙ্কার
কান আল্লাহর দেওয়া একটি নিয়ামত। এই নিয়ামত সম্পর্কে কিয়ামতে সকলকে জবাবদিহি করতে হবে। অতএব কানে তাই শোনা উচিত, যাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অনুমতি আছে। আল্লাহর দেওয়া এই কান দিয়ে গান-বাজনা, গীবত, চুগলী ইত্যাদি শোনা হারাম। হারাম কানাচি পেতে কারো গোপন কথা শোনা। কান ফুঁড়িয়ে অলঙ্কার ব্যবহার মহিলার জন্য বৈধ। কথিত আছে যে, সর্বপ্রথম বিবি হাজার (হাজেরা) কান ফুঁড়িয়েছিলেন।[1]
আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর যুগে মহিলারা কান ফুঁড়িয়ে তাতে অলঙ্কার ব্যবহার করতেন। একদা রসূল (সাঃ) ঈদের খুতবায় মহিলাদেরকে নসীহত করে সদকাহ করতে বললেন। তা শুনে মহিলারা নিজ নিজ কানের অলংকার ও হাতের আংটি সদকাহ করেছিলেন।[2]
[1]. আল-বিদায়াহ অন-নিহায়াহ ১/১৫৪ [2]. বুখারী তাওহীদ পাবঃ হা/ ৯৮, মুসলিম আল-মাকতাবাতুশ-শামেলা হা/৭৯

নাক, নাকের পরিচ্ছন্নতা ও অলঙ্কার
নাক পানি দিয়ে পরিষ্কার রাখা প্রকৃতিগত একটি সুন্নাত। আর তার জন্য রয়েছে ওযূর বিধান।
নাক ছিদ্র করার প্রথা রসূল (সাঃ) বা তাঁর সাহাবার যুগে ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে দেশের প্রথা হিসাবে মহিলা নাক ফুড়িয়ে তাতে কোন অলঙ্কার ব্যবহার করতে পারে।[1] ব্যবহার করতে পারে লাগামের মত নাকের নথ।[2]
[1]. ফাতাওয়া মারআহ ৮২পৃঃ [2]. মাজমূউ ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ৪/১৩৭

হাত ও তার অলঙ্কার
মেহেন্দি লাগিয়ে হাত রঙিয়ে রাখাই মহিলার কর্তব্য। যাতে মহিলার হাত থেকে পুরুষের হাত পৃথক বুঝা যায়। রাসুল (সাঃ) এর যুগে মহিলারা মেহেন্দি দ্বারা রঙিয়ে রাখত।
হাতের চুড়ি প্রচলিত ছিল তখনও। অবশ্য তা বিবাহিত মহিলা চিহ্নরূপে প্রচলিত ছিল না। বলাই বাহুল্য যে, বিবাহিত মহিলার হাতে চুড়ি রাখা জরুরী ভাবা, চুড়ি খুললে স্বামীর কোন ক্ষতি হবে ধারণা করা অথবা হাত খালি করতে নেই মনে করা শির্ক ও বিদআত।
যেমন বেগানা পুরুষের হাতে চুড়ি পরা মুসলিম মহিলার জন্য হারাম ও অতি ধৃষ্টতার পরিচয়। হারাম হল চুড়ির ঝন্ঝনানি দ্বারা পর-পুরুষের মন ও দৃষ্টি আকর্ষণ করা।
হাতের বাজুতে বাজুবন্দ বা আর্মলেট, হাতে ঘড়ি বা ব্রেসলেট ব্যবহার অবৈধ নয়। তবে তা বেগানা পুরুষের চোখের সামনে গোপন করতে হবে।
অনেকের মতে মহিলার কব্জি পর্যন্ত উভয় হাতও গোপনীয় অঙ্গ। অতএব তা বেগানা পুরুষের সামনে বোরকা বা চাদর দ্বারা অথবা হাত মোজা বা দস্তানা দ্বারা পর্দা করা ওয়াজেব। আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর যুগে মহিলারা দস্তানা ব্যবহার করত। তাই ইহরামের সময় তা পরতে নিষেধ করা হয়েছে।
হাতের চামড়া দেগে বা সূচিবিদ্ধ করে নকশা করা বা উলকি অাঁকা বৈধ নয়। এমন যে করে ও করায় সে অভিশপ্তা।
হযরত ইবনে মসঊদ (রাঃ) বলতেন, ‘(হাত বা চেহারায় সুচ বিদ্ধ করে) যারা উলকি-নকশা করে দেয় অথবা করায়, চেহারা থেকে যারা লোম তুলে ফেলে (বা ভ্রূ চাঁছে), সৌন্দর্য আনার জন্য যারা দাঁতের মাঝে ঘসে (ফাঁক ফাঁক করে) এবং আল্লাহর সৃষ্টি-প্রকৃতিতে পরিবর্তন ঘটায় (যাতে তাঁর অনুমতি নেই) এমন সকল মহিলাদেরকে আল্লাহ অভিশাপ করুন।’
বনী আসাদ গোত্রের উম্মে ইয়াকূব নামক এক মহিলার নিকট এ খবর পৌঁছলে সে এসে ইবনে মাসউদ (রাঃ) কে বলল, ‘আমি শুনলাম, আপনি অমুক অমুক (কাজের) মহিলাদেরকে অভিশাপ করেছেন।’ তিনি বললেন, ‘যাদেরকে আল্লাহর রসূল (সাঃ) অভিশাপ করেছেন এবং যার উল্লেখ আল্লাহর কিতাবে রয়েছে তাদেরকে অভিশাপ করতে আমার বাধা কিসের?’ উম্মে ইয়াকূব বলল, ‘আমি (কুরআন মাজীদের) আদ্যোপান্ত পাঠ করেছি, কিন্তু আপনি যে কথা বলছেন তা তো কোথাও পাইনি।’ ইবনে মসঊদ (রাঃ) বললেন, ‘তুমি যদি (গভীরভাবে) পড়তে, তাহলে অবশ্যই সে কথা পেয়ে যেতে। তুমি কি এ আয়াত পড়নি?’
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا
অর্থাৎ, রসূল তোমাদেরকে যা(র নির্দেশ) দেয় তা গ্রহণ (ও পালন) কর এবং যা নিষেধ করে তা হতে বিরত থাক।’’[1]
উম্মে ইয়াকূব বলল, ‘অবশ্যই পড়েছি।’ ইবনে মসঊদ (রাঃ) বললেন, ‘তাহলে শোন, তিনি ঐ কাজ করতে নিষেধ করেছেন।’ মহিলাটি বলল, ‘কিন্তু আপনার পরিবারকে তো ঐ কাজ করতে দেখেছি।’ ইবনে মসঊদ (রাঃ) বললেন, ‘আচ্ছা তুমি গিয়ে দেখ তো।’
মহিলাটি তাঁর বাড়ি গিয়ে নিজ দাবী অনুযায়ী কিছুই দেখতে পেল না। পরিশেষে ইবনে মসঊদ (রাঃ) তাকে বললেন, ‘যদি তাই হত তাহলে আমি তার সাথে সহবাসই করতাম না।[2]
[1]. সূরা হাশর-৫৯:৭ [2]. বুখারী তাওহীদ পাবঃ হা/৪৮৮৬, মুসলিম আল-মাকতাবাতুশ-শামেলা হা/২১২৫, আসহাবে সুনান

আঙ্গুল ও তার সৌন্দর্য
রাসুল (সাঃ) এর যুগে মহিলারা আংটি ব্যবহার করত। তবে লোহার আংটি ব্যবহার বৈধ নয়। বৈধ নয় পয়গামের আংটি। যেমন কোন বালা-মসীবত দূর করার জন্য কোন আংটি ব্যবহার করা শির্ক।
কোন বিকৃত অঙ্গে সৌন্দর্য আনয়নের জন্য অপারেশন বৈধ। কিন্তু ত্রুটিহীন অঙ্গে অধিক সৌন্দর্য আনয়নের উদ্দেশ্যে অস্ত্রোপচার করা বৈধ নয়।[1] পক্ষান্তরে অতিরিক্ত আঙ্গুল বা মাংস হাতে বা দেহের কোন অঙ্গে লটকে থাকলে তা কেটে ফেলা বৈধ।[2] কোন আঙ্গিক ত্রুটি ঢাকার জন্য কৃত্রিম অঙ্গ ব্যবহার দূষণীয় নয়। যেমন, সোনার বাঁধানো নাক, দাঁত ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়।[3]
[1]. ফাতাওয়াল মারআহ ৯২পৃঃ [2]. যীনাতুল মারআতিল মুসলিমাহ ১২২ পৃঃ [3]. ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ২/৮৩৩

পা ও তার অলঙ্কার
মহিলাদের পায়ের অলঙ্কার রসূল (সাঃ) এর যুগেও প্রচলিত ছিল। বর্তমানেও পায়ের মল, নুপুর বা তোড়া যদি বাজনাহীন হয় এবং বেগানা পুরুষ থেকে গুপ্ত রাখা হয়, তাহলে তা বৈধ।
মহিলার পায়ে ঘুঙুর ও বাজনাবিশিষ্ট নুপুর স্বামী ও এগানা ছাড়া অন্যের কাছে প্রকাশ পাওয়া হারাম। যেহেতু প্রত্যেক বাজনার সাথে শয়তান থাকে। আর সেই শয়তান পর-পুরুষের মন ও দৃষ্টিকে ঐ ভাবুনী মহিলার দিকে আকৃষ্ট করে। সে মহিলা হয়তো বা নিজে পর-পুরুষের দিকে আকৃষ্ট হয় এবং পর-পুরুষকেও নিজের দিকে আকৃষ্ট করে। তাইতো সৃষ্টিকর্তা মহিলাদেরকে সতর্ক করে বলেন,
وَلَا يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِينَ مِنْ زِينَتِهِنَّ
অর্থাৎ, তারা যেন তাদের গোপন আভরণ প্রকাশের উদ্দেশ্যে সজোরে পদক্ষেপ না করে----।[1]
অনেকের মতে মহিলাদের জন্য বেগানার সামনে পায়ের পাতা ঢাকাও ওয়াজেব। আর তার জন্য পা-মোজা ব্যবহার করা কর্তব্য।
[1]. সূরা নূর-২৪:৩১
ইসলামী জীবন-ধারা অধ্যায়ঃ মহিলার সাজ-সজ্জা

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন