উচ্চরক্তচাপকে মেডিকেল ভাষায় Hypertension বলে। রক্ত প্রবাহিত হওয়ার সময় রক্তনালির গাত্রে যে চাপ প্রয়োগ করে, তাকে রক্তচাপ বলে। রক্তচাপ হৃদপিণ্ড থেকে একক সময়ে সম্মুখে সঞ্চালিত রক্তের পরিমাণ এবং রক্তনালির প্রতিবন্ধতার (resistance)-এর ওপর নির্ভর করে। যদি স্বাভাবিকের চেয়ে রক্তচাপ অনবরত (persistently) বেশি থাকে, তাকে উচ্চরক্তচাপ বা হাইপারটেনশন বলে। অনবরত কথা বলা হয়েছে এ কারণে, যখন মানুষ মানসিক চাপ, অপরিচিত পরিবেশ ও পরিশ্রম বা ব্যায়াম করে, তখন রক্তচাপ বেড়ে যায়। এ সময় রক্তচাপ মাপলে বেশি পাওয়া যাবে। তাকে আমরা উচ্চরক্তচাপ বলব না। আবার ডাক্তার চেম্বারে যখন রক্তচাপ মাপেন, তখন ২০ শতাংশ রোগীর রক্তচাপ বেশি পাওয়া যায়। এদের যদি বাড়িতে রক্তচাপ মাপা হয়, তবে স্বাভাবিক পাওয়া যায়। একে white coat hypertension বলে। আবার একবার মেপে যদি রক্তচাপ বেশি পাওয়া যায়, পাঁচ মিনিট বিশ্রামের পর আবার রক্তচাপ মাপা উচিত। রক্তচাপ দুই হাতেই মাপা উচিত। বসা অবস্থায় বাহুটা হৃদপিণ্ডের লেভেলে রেখে রক্তচাপ মাপা উচিত এবং বয়স্ক এবং ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে বসা এবং দাঁড়ানো অবস্থায় রক্তচাপ মাপা উচিত। রক্তচাপ মাপার জন্য যে যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, সেটাকে আমরা sphygmomanometer বলি বা রক্তচাপ মাপা যন্ত্র বলি। কাপড়ের মধ্যে একটি রাবারের ব্যাগ থাকে কাপড়টাকে বাহুতে পেঁচিয়ে পাম্প করে ফুলানো হয়। যাতে ব্যাগের চাপে হাতের রক্ত সাময়িক সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে চাপ কমালে ধমনির উপরে রাখা স্টেথোস্কোপের প্রথম যে শব্দটি পাওয়া যায়, সেটিকে সিস্টোলিক এবং যখন শব্দ বন্ধ হয়ে যাবে, সেটাকে ডায়াস্টোলিক প্রেসার বলে। রক্তচাপ সঠিকভাবে মাপার জন্য সঠিক মাপের cuff size হতে হবে। স্বাভাবিক সাইজ এর পঁভভ দিয়ে মোটা মানুষের রক্তচাপ মাপলে রক্তচাপ অনেক বেশি হবে।
আমাদের স্বাভাবিক রক্তচাপ ১২০/৮০ মিলিমিটার মারকারি-এর নিচে, তবে ১২০ থেকে ১৩৯/৮০-৯৯ মিমি. মারকারিকে হাইনরমাল বা প্রিহাইপারটেনশন বলে। ব্রিটিশ হাইপারটেনশন সোসাইটি রক্তচাপকে ৩ স্টেজে ভাগ করেছে-
Stage-1 : 140-159/90-99 মিমি. মারকারি
Stage-2 : 160-179/100-109 মিমি. মারকারি
Stage-3 : 180/110 মিমি. মারকারি
উচ্চরক্তচাপ থাকলে স্ট্রোক, হৃদরোগ, কিডনি রোগের ঝুঁকি বেশি। তাই উচ্চরক্তচাপ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান ও সচেতন থাকা উচিত। উচ্চরক্তচাপকে কারণ অনুসারে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে-
প্রাইমারি-যার কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ নেই। যদিও কারণ নেই, তথাপি কিছু কিছু ঝুঁকিপূর্ণ জিনিস উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টিতে অবদান রাখে। যেমন-
* ষাটোর্ধ্ব বয়স * পুরুষ * বংশগত * স্থূলতা * অতিরিক্ত লবণ খাওয়া * অলস জীবনযাপন * অতিরিক্ত মদ্যপান।
উচ্চরক্তচাপের শতকরা ৯৫ ভাগই প্রাইমারি। সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন- শতকরা ৫ ভাগ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কারণ থাকে। যেমন-
* কিডনি রোগ * হরমোনজনিত রোগ * গর্ভাবস্থা * স্থূলতা।
উপসর্গ
Essential hypertension অনেক দিন বসে ধীরে ধীরে সৃষ্টি হয়। সাধারণত এর কোনো উপসর্গ থাকে না। উচ্চরক্তচাপ screening বা অন্য কারণে ডাক্তারের কাছে গেলে রক্তচাপ মাপলে ধরা পরে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মাথার পিছনে ব্যথা হয় বা উচ্চরক্তচাপের জটিলতা নিয়ে ডাক্তারের কাছে আসতে পারে। যে essential hypertension অনেক দিন বসে হয় এবং কোনো উপসর্গ থাকে না, যা নীরবে রক্তনালি ও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে ক্ষতি করতে পারে। তাই উচ্চ রক্তচাপকে প্রারম্ভে নির্ণয়ের জন্য ১৮-৩৯ বছরের মধ্যে ২ বছরে একবার রক্তচাপ পরিমাপ করা উচিত। আর ৪০ বছরের উপরে হলে বছরে একবার রক্তচাপ পরিমাপ করা উচিত।
দীর্ঘদিন নিয়ন্ত্রণহীন উচ্চরক্তচাপ থাকলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গের ক্ষতি করতে পারে। যেমন- স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, কিডনি রোগ, হার্ট ফেইলুর।
মূল্যায়ন
উচ্চরক্তচাপ শনাক্ত করা সহজ। ২ অধিবেশনে ৩ বার যদি বিশ্রামে থাকা অবস্থায় রক্তচাপ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়, তাকে উচ্চরক্তচাপ বলে। তবে উচ্চরক্তচাপ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে। কেননা, উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, ভালো (cure) হয় না এবং রোগীকে সারা জীবন ওষুধ খেতে হয়।
সার্বিক মূল্যায়ন করতে হলে রোগীর ইতিহাস নিতে হবে। কোনো risk factor (family history, alcohol, secondary
cause) আছে কিনা। পরীক্ষা করতে হবে; কোনো কারণ আছে কিনা বা জটিলতা হয়েছে কিনা। অন্য কোনো রোগ আছে কিনা বা ওষুধ গ্রহণ করে কিনা, যা উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসায় পরিবর্তন প্রয়োজন হতে পারে।
পরীক্ষা
সামান্য কিছু পরীক্ষা যেমন- urine for protein, red cells, s. creatinine Ges ECG.
ব্যবস্থা
উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, ভালো (cure) হয় না। ৫ মিমি. রক্তচাপ কমালে ৩৪ শতাংশ স্ট্রোক, ২১ শতাংশ হার্ট অ্যাটাক ও অন্যান্য জটিলতা কমে। তাই উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত জরুরি। এজন্য আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চলবেন।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায় হলো-
* জীবনধারার পরিবর্তন (lifestyle modification)
* ওষুধ
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, রক্তচাপ কত রাখা উচিত।
সাধারণত রক্তচাপ ১৪০/৯০ মিমি. মারকারির নিচে রাখার সুপারিশ করা হয়। ৮০ বছরের ওপরে ১৫০/৯০ রাখার সুপারিশ করা হয়। ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগীর ক্ষেত্রে ১৩০/৮০ রাখা উচিত। American heart association উপরের রক্তচাপ ১৪০ এবং নিচের রক্তচাপ ৯০ এর উপরে গেলে ওষুধ ব্যবহারের সুপারিশ করেছে।
জীবন যাত্রার পরিবর্তন
২০০৩ সালের একটি ক্লিনিক্যাল রিপোর্ট অনুযায়ী, শুধু জীবনধারার পরিবর্তন ৩৮ শতাংশ উচ্চরক্তচাপ কমাতে সক্ষম। জীবনধারার পরিবর্তন হলো-
* শরীরের ওজন স্বাভাবিকের মধ্যে রাখা (BMI- 20-25 Kg/m 2)
* খাদ্যে খাবার লবণ কম খাবেন
* নিয়মিত ব্যায়াম করবেন (৩০ মিনিট বা তার বেশি হাঁটা সপ্তাহে প্রায় ৫ দিন)
* সবুজ শাকসবজি ও ফলমূল খাবেন
* খাদ্যে পটাশিয়ামের পরিমাণ বাড়াতে হবে।
* চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করা
* সবুজ চা পান।
* ধূমপান বন্ধ করা।
* এলকোহল কমিয়ে আনা।
ওষুধ
উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য অনেক রকমের ওষুধ আছে, আপনি আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধ সেবন করবেন।
লেখক : ভিজিটিং প্রফেসর, শ্রী বালাজী মেডিকেল কলেজ ডিমড ইউনিভার্সিটি, চেন্নাই ও এক্স প্রফেসর, মেডিসিন, শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ, বরিশাল
সূত্র: যুগান্তর
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন