নিজার বানাত: যার মৃত্যু ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নেতৃত্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছে

ফেসবুকে পোস্ট করা ভিডিওতে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নেতাদের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন নিজের বানাত।

পশ্চিম তীরের শহর হেবরনে 'শহীদদের' কবরস্থানে একটি নতুন কবরের পাশে নীরবে প্রার্থনা করছে দু'জন পুরুষ। এই কবরস্থানে যাদের কবর দেয়া হয়েছে, তাদের বেশিরভাগই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সংঘাতে নিহত হয়।

তবে নিজার বানাত তার জীবন এক নতুন সংগ্রামের জন্য উৎসর্গ করেছেন বলে বিশ্বাস করে তার পরিবার। তার এই সংগ্রাম ছিল ক্রমশ স্বৈরাচারি হয়ে উঠা ফিলিস্তিনিদের নিজেদের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে।

"আমি যা প্রত্যক্ষ করেছিলাম, তা ছিল আসলে একটি হত্যা অভিযান," বলছেন নিজার বানাতের চাচাতো ভাই হোসেইন বানাত। ২৪শে জুন রাতে যখন ফিলিস্তিনি নিরাপত্তা কর্মকর্তারা নিজার বানাতকে ধরে নিয়ে যেতে আসে, তখন তার পাশেই শুয়ে ছিলেন তিনি। হত্যার হুমকি পাওয়ার পর থেকে নিজার বানাত লুকিয়ে ছিলেন তার বাড়িতে।

হোসেইন বানাত জানান, প্রায় এক ডজন ফিলিস্তিনি নিরাপত্তা কর্মকর্তা ঘরে ঢুকেই তার ভাইয়ের মাথায় লোহার শাবল দিয়ে আঘাত করতে থাকে।

"ওদের উদ্দেশ্য যদি হতো আমার ভাইকে গ্রেফতার করা, ও তো ঘুমিয়েই ছিল- হত্যা করার পরিবর্তে হাতে হাতকড়া পরিয়ে ওকে নিয়ে যেতে পারতো," বলছেন তিনি।

    নিজার বানাতের চাচাতো ভাই (ডানে) বলছেন, গ্রেফতারের সময় তাকে মারধোরের কোন কারণ ছিল না।
    ছবির ক্যাপশান,

    নিজার বানাতের চাচাতো ভাই (ডানে) বলছেন, গ্রেফতারের সময় তাকে মারধোরের কোন কারণ ছিল না।

    সেই রাতে নিরাপত্তা ক্যামেরায় যে ফুটেজ রেকর্ড করা হয়, তাতে দেখা যায়, মি. বানাতকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তারপর একটি গাড়িতে তোলা হচ্ছে। এর এক ঘণ্টা পরেই তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

    'এরকম ঘটা উচিৎ ছিল না'

    বিয়াল্লিশ-বছর বয়সী নিজার বানাত সোশ্যাল মিডিয়ায় খোলাখুলি ফিলিস্তিনি দল ফাতাহর নেতাদের সমালোচনা করতেন এবং তার এই ব্যতিক্রমী ভূমিকার জন্য তিনি পরিচিতি পেয়েছিলেন। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) ক্ষমতায় আছে ফাতাহ। মি. বানাত ফাতাহর নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিলেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় তার এই সংক্রান্ত পোস্টগুলো দেখতো হাজার হাজার মানুষ।

    একজন সমালোচককে চুপ করিয়ে দেয়াই যদি নিজার বানাতকে টার্গেট করার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, এতে বরং ফল হয়েছে উল্টো: তার মৃত্যুতে ক্রুদ্ধ বিক্ষোভ শুরু হয় ফিলিস্তিনি এলাকায়।

    সাদা পোশাকধারি ফিলিস্তিনি নিরাপত্তা কর্মকর্তারা রামাল্লায় এক বিক্ষোভকারীকে আটক করছে।

    ছবির উৎস

    ছবির ক্যাপশান,

    সাদা পোশাকধারি ফিলিস্তিনি নিরাপত্তা কর্মকর্তারা রামাল্লায় এক বিক্ষোভকারীকে আটক করছে।

      ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগকে কেন্দ্র করে ক্ষোভ বাড়ছিল অনেকদিন ধরেই, বিশেষ করে এপ্রিল মাসে যখন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস আইন পরিষদ এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বাতিল করেন। গত ১৫ বছরের মধ্যে এই প্রথম সেখানে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল।

      ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ দাবি করেছিল, তাদের নির্বাচন স্থগিত রাখতে হয়েছে, কারণ ইসরায়েল পূর্ব জেরুসালেমের বেশিরভাগ ফিলিস্তিনিকে ভোটে অংশ নিতে দিচ্ছিল না। তবে অনেকের বিশ্বাস, মিস্টার আব্বাসের ফাতাহ দলের মধ্যে যে কোন্দল এবং তার জনপ্রিয়তায় যেরকম ভাটা পড়েছে, সেজন্যেই তিনি নির্বাচন বাতিল করেন।

      রামাল্লাহর রাস্তায় সাম্পতিক সপ্তাহগুলোতে এমন একটি শ্লোগান শোনা যাচ্ছে, যেটি ২০১১ সালে মধ্যপ্রাচ্যে আরব বসন্তের বিক্ষোভের সময় সবচেয়ে জনপ্রিয় শ্লোগানে পরিণত হয়েছিল: "জনগণ এই শাসকগোষ্ঠীর পতন চায়।"

      রামাল্লায় এরকম কিছু বিক্ষোভ সহিংস উপায়ে দমন করা হয়, এমনকি সাংবাদিকদের ওপরও হামলা চালায় ফিলিস্তিনি বাহিনী।

      ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ ইশতেয়াহ নিজার বানাতের হত্যার তদন্ত হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, পেশাদারিত্বের সঙ্গে এবং স্বচ্ছতা বজায় রেখে এই তদন্ত চালানো হবে।

      ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা বাহিনীর ১৪ জন অফিসারের বিরুদ্ধে এই ঘটনার ব্যাপারে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। তবে এদের কেউই উচ্চপদস্থ কোন কর্মকর্তা নন। তাদেরকে একটি সামরিক আদালতে বিচার করা হবে।

      "নিজার বানাতের হত্যাকান্ড একটি ভুল ছিল এবং এটা ঘটা উচিৎ ছিল না," বলছেন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সাবেক এক মন্ত্রী সাবরি সাইদাম। তিনি এখন ফিলিস্তিনি দল ফাতাহর কেন্দ্রীয় কমিটির সেক্রেটারি জেনারেল।

      সাবরি সাইদাম বলছেন কিছু ‌'বহিরাগত' এসব বিক্ষোভকে ব্যবহার করছে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে বিব্রত করতে।
      ছবির ক্যাপশান,

      সাবরি সাইদাম বলছেন কিছু ‌'বহিরাগত' এসব বিক্ষোভকে ব্যবহার করছে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে বিব্রত করতে।

      তিনি আমাকে বললেন, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের যারা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী, যাদের মধ্য গাযা নিয়ন্ত্রণকারী হামাসও আছে, তারা এই ঘটনাকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চাইছে।

      "মানুষের ক্ষোভটা কোথায় সেটা আমি বুঝতে পারি", বলছেন তিনি। "কিন্তু পরিস্থিতি যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে তখন আমরা দেখেছি যেসব বিক্ষোভ চলছিল, তার পেছনে রাজনৈতিক কূটচাল ছিল।"

      "এটা কেবল মুক্তভাবে কথা বলার অধিকারের বিষয় নয়। এটি আসলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, আর এখানে কিছু বহিরাগত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাজ-কর্মে অন্তর্ঘাত চালানোর জন্য খেলছে।"

      'স্বৈরাচারের চেহারা নিচ্ছে'

      ইসরায়েল এবং পশ্চিমা দেশগুলো ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে সমর্থন জোগায়। কারণ তারা মনে করে হামাসকে ঠেকাতে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে দরকার। কারণ এসব দেশ হামাসকে একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন বলে বিবেচনা করে।

      তবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে তাদের কাজকর্ম চালানোর জন্য ব্যাপকভাবে আন্তর্জাতিক সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। তাদের দাতা দেশের মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্য। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়া এবং সুসজ্জিত করার জন্য এসব দেশ অনেক অর্থ দিয়েছে।

      কিন্তু গত কয়েক মাসে দেখা যাচ্ছে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের যারা সমালোচক, তাদের ধরপাকড় বেড়েছে। মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো একে মত প্রকাশের স্বাধীনতা দমন বলে বর্ণনা করে নিন্দায় সোচ্চার হয়েছে।

      অগাস্ট মাসে কয়েকজন সুপরিচিত বিক্ষোভকারী যখন একটি বিক্ষোভে যোগ দিতে যাচ্ছেন, তখন তাদের ধরা হয়। তবে বিদেশি কূটনীতিকরা উদ্বেগ প্রকাশ করার পর তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।

      এদের একজন ছিলেন উবাই আল-আবুদি, তিনি বিসান সেন্টার ফর রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্টের পরিচালক। মুক্তি পেয়ে নিজের তিন ছেলে এবং স্ত্রীর কাছে ফিরে আসতে পেরে তিনি খুশি। তবে যে কাজের জন্য তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, সেটির জন্য তার মধ্যে কোন অনুতাপ নেই।

      ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করে উবাই আল-আবুদি বলছেন, ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব সব দিক থেকেই ব্যর্থ।
      ছবির ক্যাপশান,

      ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করে উবাই আল-আবুদি বলছেন, ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব সব দিক থেকেই ব্যর্থ।

      "আমি যে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের একজন সমালোচক, সেটা নিয়ে আমি লজ্জিত নই। তারা রাজনৈতিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে, তারা অর্থনৈতিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে- আমি দেখছি তারা সবদিক থেকেই ব্যর্থ। আমরা এখন দিনে দিনে আরও বেশি করে স্বৈরাচারের পথেই যাচ্ছি,‍" বলছেন তিনি।

      তিনি জানান, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের ক্ষমতায় যে রাজনৈতিক সুবিধাভোগীরা, তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। মাহমুদ আব্বাসের পর কে নেতৃত্ব নেবে, পদ-পদবী ব্যবহার করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে, সেটা নিয়ে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেছে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের ভেতরে।

      "এরা দুর্নীতি আর একচেটিয়া ক্ষমতার মাধ্যমে সেখানে একরকম নিজেদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে, অন্যদিকে সাধারণ ফিলিস্তিনিরা দিনে দিনে আরও নিঃস্ব হচ্ছে।

      নিজার বানাতের মৃত্যুর পর ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভের প্রকাশ দেখা গেছে।

      ছবির উৎস

      ছবির ক্যাপশান,

      নিজার বানাতের মৃত্যুর পর ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভের প্রকাশ দেখা গেছে।

      জুলাই মাসে একটি বেআইনি বিক্ষোভ আয়োজনের অভিযোগে গত সপ্তাহে মি. আল-আবুদি এবং অন্যদেরকে আদালতে নেয়া হয়। তখন সেখানে যান ইউরোপীয় পর্যবেক্ষকরা। তাদের মামলাটি অক্টোবর মাস পর্যন্ত স্থগিত রাখা হয়েছে। এই বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে বাজে ভাষায় গালাগালি করার একটি পৃথক অভিযোগও আনা হয়েছে।

      নিজার বানাতের স্ত্রী জিহান পাঁচ সন্তানকে নিয়ে থাকেন হেবরনের কাছে দুরায় তার বাড়িতে। সেখানে তিনি প্রয়াত স্বামীর ফেসবুক ভিডিওগুলো দেখছিলেন।

      "আমরা সবসময় তার অনুপস্থিতি অনুভব করি। তার কন্ঠস্বর এখনো যেন আমাদের মধ্য ধ্বনিত হচ্ছে। আমরা তার জন্য লড়াই চালিয়ে যাব," বললেন তিনি। "তার রক্ত বৃথা যেতে পারে না।"

      ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোন ন্যায়বিচার পাবেন বলে বিশ্বাস করেন না বানাত পরিবার। তারা 'প্রিন্সিপাল অব ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশনের' অধীনে এখন এই হত্যাকান্ড ব্রিটিশ পুলিশকে তদন্ত করার অনুরোধ জানিয়েছেন। তারা জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর কাছেও সাহায্য চেয়েছেন।

      নিজার বানাতের স্মরণে আরও কিছু বিক্ষোভের প্রস্তুতি চলছে। তবে এসব বিক্ষোভ আরও ব্যাপক রূপ নেয় কীনা, তা দেখতে হবে।

      বহু ফিলিস্তিনিই রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রত্যাশা করেন, কিন্তু এই বিক্ষোভকারীর মৃত্যু অনেককেই শংকিত করে তুলেছে, তারা এখন খুব বেশি সোচ্চার হতে ভয় পাচ্ছেন।

      সূত্র : বিবিসি বাংলা

      Post a Comment

      নবীনতর পূর্বতন