নোয়াখালী বিমানবন্দর নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই থমকে আছে

করোনা মহামারীতে অর্থাভাবের দরুন থমকে আছে নোয়াখালী বিমানবন্দর নির্মাণ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সমীক্ষা। নোয়াখালীবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ করতে জেলার সদর উপজেলার ধর্মপুর ইউনিয়নের উত্তর ওয়াপদা বাজার এলাকায় পূর্ণাঙ্গ বিমান বন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেয় বর্তমান সরকার। উন্নয়নে ধারাবাহিকতায় এ প্রকল্পটি নেয়া হয় বছর দুয়েক আগে। এ জন্য নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে জরুরী ভিত্তিতে সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। দুর্ভাগ্য- তারপরই দেখা দেয় করোনার ছোবল। এলাকাবাসীর মতে- করোনার ছোবল না থাকলে এতদিনে এ প্রকল্পের সমীক্ষা হয়ে যেত এবং এতদিনে অনেকটাই এগিয়ে যেত। সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়- সমীক্ষা না হওয়ায় এখনও পূর্ণাঙ্গভাবে ভ‚মি অধিগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।

জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট মাহবুব আলী এমপি বলেন- শুধু নোয়াখালী নয়-দেশের শমসেরপুর, ফেনী, কুমিল্লা, লালমনিরহাটসহ অন্যান্য জেলায় যেখানে এয়ারফিল্ড বা এয়ারস্ট্রিপ রয়েছে সেগুলোকে সামান্য সংস্কার করে ছোট ছোট এয়ারক্রাফট চালানোর সুযোগ রয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় কম পয়সায় যদি ৫০ আসনের ছোট এয়ারক্রাফট অপারেট করা যায় তাহলে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা উজ্জ্বল। যেমন ইন্দোনেশিয়াতে এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে ছোট ছোট প্লেন বাণিজ্যিকভাবে চলাচল করে। নোয়খালীসহ দেশের অন্যান্য জেলাতেও বাণিজ্যিকভাবে আকাশপথ চালু করা যেতে পারে। বিশেষ করে বাজেট এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে শুধু দেড় দুই হাজার টাকায় ভাড়া নেয়া হলে এয়ারপোর্ট হিসেবে ব্যবহার করা যাবে এসব এয়ারফিল্ড।

অর্থাভাবে নোয়াখালী বিমানবন্দর তৈরির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সমীক্ষা থমকে যাবার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখন তো দেশের করোনা মহামারী চলছে। এমনিতেই নানা ধরনের সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। হয়ত সে কারণেই অর্থ যোগান দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলে অবশ্যই এ প্রকল্পের কাজ শুরু হবে।

এলাকাবাসীর বিশ্বাস- নোয়াখালীতে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠা হলে এ অঞ্চলে বদলে যাবে উন্নয়নের চিত্র ও অর্থনৈতিক জীবনযাত্রা। এতে শিল্প সম্ভাবনা ও নিঝুম দ্বীপে দেশী-বিদেশী পর্যটক বাড়বে। অপরদিকে পূর্ণাঙ্গ বিমানবন্দর নির্মাণ করার পর নোয়াখালী উপক‚লে পর্যটন সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো এবং ঢাকা-নোয়াখালী-হাতিয়া-চট্টগ্রাম রুটে বাণিজ্যিকভাবে বিমান চলাচলের অনুমোদন দিলে বদলে যাবে বৃহত্তর এ জেলার দৃশ্যপট। নিঝুম দ্বীপে ঘুরতে আসতে পারবেন বিদেশী পর্যটকরা। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় অনেক বিদেশী পর্যটক আসতে চাইলেও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় আসতে পারছেন না।

জানা যায়, বছর তিনেক আগে তৎকালীন মন্ত্রী একে এম শাহজাহান কামালের নেতৃত্বে মন্ত্রণালয় ও সিভিল এভিয়েশানের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল নোয়াখালী বিমানবন্দরের সম্ভাব্য স্থান পরিদর্শন করেন। সেদিন তারা ঘোষণা দেন- বৃহত্তর নোয়াখালীবাসীর বিমানবন্দরের স্বপ্ন পূরণের পথে। তাদের দীর্ঘদিনের দাবি নোয়াখালী বিমানবন্দর নির্মাণের দ্বার খুলতে যাচ্ছে। তারা প্রস্তাবিত বিমানবন্দরের জমি পরিদর্শন করেন। এ সময় তারা চর শুলকিয়া এয়ারস্ট্রিপ পরিদর্শন করেন। এখানে এক সময় কৃষি জমিতে কীটনাশক ছিটানোর জন্য এই রানওয়েটি তৈরি করা হয়। স্বাধীনতার পরও এখানে নিয়মিত ছোট আকারে উড়োজাহাজ কীটনাশক ছিটানোর কাজ করত। আশির দশকের মাঝামাঝি তা পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। তারপর থেকেই মূলত এখানে এটিকে বিমানবন্দর তৈরির দাবি জোরালো হতে থাকে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমে সদর উপজেলার ধর্মপুর ইউনিয়নের উত্তর ওয়াপদা বাজারে সন্নিকটে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের বিশাল জমি প্রস্তাবিত বিমানবন্দরের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর নোয়াখালীর উপক‚লীয় অঞ্চলের বিস্তীর্ণ ফসলি জমিতে কৃষি বিভাগের কীটনাশক ওষুধ ছিটানোর জন্য ওই সময়ে বঙ্গবন্ধু সরকার প্রায় ৪০ একর জায়গা অধিগ্রহণ করে। তারপর এখানে ছোট বিমান অবতরণের একটি রানওয়ে নির্মাণ করে। পরবর্তীতে এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। দীর্ঘদিন থেকে নোয়াখালীসহ পার্শ্ববর্তী জেলা ফেনী ও ল²ীপুর জেলার সর্বস্তরের মানুষের দাবি ছিল ওই পরিত্যক্ত রানওয়েকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়ে আরও জমি অধিগ্রহণ করে বৃহত্তর নোয়াখালীর জন্য একটি বিমানবন্দর করার। বিগত সময়ে সরকার প্রধানদের কাছে বৃহত্তর নোয়াখালীবাসী বিমানবন্দরের জন্য দাবি জানিয়ে আসলেও তা কেউ কার্যকর করতে এগিয়ে আসেননি। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী, স্থানীয় সংসদ সদস্য একরামুল হক চৌধুরী নোয়াখালীতে বিমানবন্দর করার অনুরোধ জানান। প্রধানমন্ত্রীর সবুজ সঙ্কেত পেয়েই সাবেক মন্ত্রী এ কে এম শাহজাহান কামাল নোয়াখালীতে বিমানবন্দর নির্মাণ করার জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম শুরু করেন। তখনই বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সিভিল এভিয়েশন অথরিটির পক্ষ থেকে সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি সমীক্ষা কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু এভিয়েশন অথরিটি কোন ফান্ড না দেয়ায় এ সমীক্ষা কমিটির কাজ করতে বিলম্ব হচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিমানবন্দর সমীক্ষা কমিটির সদস্য সচিব ড. মোঃ ইউছুফ মিয়া জানান, বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সিভিল এভিয়েশন অথরিটি কোন ধরনের ফান্ড না দেয়ায় আমরা কাজ করতে পারছি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ মোট সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি সমীক্ষা কমিটি গঠন করা হয়েছে। যে কমিটি তিন মাসের মধ্যে রিপোর্ট দেয়ার কথা থাকলেও অর্থনৈতিক ফান্ড না থাকায় কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। ফান্ড দিলে আমরা দ্রæত কাজ করব। জানা গেছে, নোয়াখালীর জেলা শহর মাইজদী হতে ১৫ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ-পশ্চিমে সদর উপজেলার ধর্মপুর ইউনিয়নের উত্তর ওয়াপদা বাজারের সন্নিকটে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পূর্বে চর শুল্যকিয়া নামকস্থানে সরকারীভাবে একটি বিমানবন্দর নির্মাণের কাজ শুরু হয়। বিমানবন্দরটি নির্মাণের জন্য তৎকালীন সময়ে কৃষি অধিদফতর বীজ সংরক্ষণের জন্য প্রায় ৪০ একর জমিও অধিগ্রহণ করা হয়। নির্মাণ সম্পন্ন হয় বিমানবন্দরের রানওয়ে।

নোয়াখালীর প্রস্তাবিত বিমানবন্দরের বিষয়ে জানতে চাইলে নোয়াখালী-৪ আসনের এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরী বলেন, নোয়াখালীতে বিমানবন্দর এখন আর স্বপ্ন নয় এটা বাস্তব। আমি বারবার বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট আবেদন করেছি। সাগরতীরের নোয়াখালীতে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠা হলে এ অঞ্চলের শিল্প সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারবে সরকার। বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলের মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কর্মরত আছে এ অঞ্চলের মানুষ যারা প্রতিনিয়তই রেমিটেন্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকাকে করছেন সমৃদ্ধিশালী। বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় নোয়াখালী অঞ্চলে প্রবাসীদের হার তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। নোয়াখালীর এ প্রবাসীরা এখন রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাধ্যমে দেশ-বিদেশে যাতায়াত করেন। বর্তমানে একটা বিষয় অবাক লাগে বিদেশ থেকে বিমানের ফ্লাইটে ঢাকা আসতে সময় লাগে যেখানে ৩-৪ ঘণ্টা সেখানে তাদের ঢাকা থেকে নোয়াখালী আসতেই লাগে ৭-৮ ঘণ্টা। এতে তাদের পোহাতে হয় সীমাহীন ভোগান্তি। প্রবাসীদের সিংহভাগ অংশ নোয়াখালীর বলে নোয়াখালীতে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠিত হলে তারা সরাসরি বিদেশ থেকে নোয়াখালীতেই আসতে পারবেন।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ আশীষ রায় চৌধুরীর ভাষ্যমতে- স্বপ্ন আর বাস্তবতা ভিন্ন। একটা বিমানবন্দর করতে গেলে প্রথমত পর্যাপ্ত জমি, অর্থ ও সময় প্রয়োজন। এসব দিক থেকে নোয়াখালীতে একটা বিমানবন্দর করার মতো উপযোগী পরিবেশ রয়েছে- যা বাণিজ্যিকভাবেও নির্ভরযোগ্য হওয়ার মতো। কারণ রাজধানী থেকে রাজশাহী, সৈয়দপুর ও যশোরের যে নটিক্যাল মাইল দূরত্ব-তার চেয়ে নোয়াখালীর দূরত্ব বেশি। দ্বিতীয়ত এখানকার আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটও যথেষ্ট শক্তিশালী যা একটা বিমানবন্দরকে চালু রাখতে সক্ষম।
জানতে চাইলে স্থানীয় আওয়ামী লীগের এমপি একরামুল হক চৌধুরী বলেন, বিগত এক দশকে অনেক উন্নয়ন করা হয়েছে এ আসনে। এখন একটা বিমানবন্দর নির্মাণ করা হলে ষোল কলা পূর্ণ হয়। কারণ- সবদিক থেকেই এখানে বিমানবন্দর নির্মাণ করার উপযুক্ত পরিবেশ রয়েছে। প্রথমত বৃহত্তর নোয়াখালীতে রয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় কয়েকটি শিল্প গোষ্ঠীর বসবাস। এখানকার সুবর্ণচরে হচ্ছে সেনা ও নৌবাহিনীর- দুটো ক্যান্টনমেন্ট। ভাসানচরে তৈরি করা হয়েছে রোহিঙ্গাদের আবাসস্থল। যেখানে আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা সারাবছরব্যাপীই সফর করবেন। বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিপুলসংখ্যক নোয়াখালীবাসী। এখানেই তৈরি হচ্ছে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল। সুবর্ণচরে একটি নৌবন্দরের পরিকল্পনা রয়েছে। হাতিয়া নিঝুম দ্বীপে রয়েছে পর্যটন কেন্দ্র তৈরির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। দেশী বিদেশী পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় এই দ্বীপে বেশ কয়েক উদ্যোক্তা বিনোদন স্পট তৈরিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এসবকিছু বিবেচনা করলে রাজশাহী ও যশোরের তুলনায় নোয়াখালীর বিমানবন্দর হবে বাণিজ্যিকভাবে অনেক নির্ভরযোগ্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, বৃহত্তর নোয়াখালীর আর্থসামাজিক অবস্থা অন্য এলাকার চেয়ে এগিয়ে।

বিমানবন্দরের জন্য সবচেয়ে বেশি যেটা প্রয়োজন সেটা হলো পর্যাপ্ত জমি। এদিক থেকে নোয়াখালীই হচ্ছে সবচেয়ে উপযোগী অঞ্চল। বর্তমান রানওয়েতে রয়েছে কয়েকশ একর অধিগ্রহণভুক্ত জমি। এর চারপাশে রয়েছে কয়েক হাজার একর খাস জমি। যেখানে নেই কোন বসতি বা উঁচু স্থাপনা। সরকার চাইলে অনায়াসেই এ জমিতে কোন ধরনের প্রতিক‚লতা ছাড়াই বিমানবন্দরের জন্য প্রয়োজনীয় ভ‚মি ব্যবহার করতে সক্ষম। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় নোয়াখালী অঞ্চলে প্রবাসীদের হার তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। নোয়াখালীতে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠিত হলে তারা সরাসরি বিদেশ থেকে নোয়াখালীতেই আসতে পারবে। একইসঙ্গে নিঝুম দ্বীপে বিদেশী পর্যটকরাও আসতে পারবে। এতে তাদের বাড়তি ভোগান্তিতে পড়তে হবে না এবং ঢাকার বিমানবন্দরের ওপরও চাপ কমে যাবে।
(কার্টেসী- স্বদেশ প্রতিদিন)

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন