আফগান শরণার্থী স্রোতের আশঙ্কায় ইউরোপ

তালেবান ক্ষমতা দখলে নেয়ায় আফগানিস্তান থেকে সম্ভাব্য শরণার্থী স্রোত নিয়ে উদ্বিগ্ন ইউরোপ৷ পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আগেই কীভাবে তা সামাল দেয়া যায় তা নিয়ে চলছে বিভিন্ন পরিকল্পনা৷

আকাশ থেকে তুরস্ক ও ইরান সীমান্তের আঁকাবাকা ৫৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন দেয়ালটি অনেকটা সাপের মতো দেখতে৷ এখন পর্যন্ত পুরো সীমান্তের এক তৃতীয়াংশে এই দেয়াল তুলতে সক্ষম হয়েছে তুরস্ক৷

এশিয়া থেকে ইউরোপে অভিবাসনের এই পথে গত বছরের তুলনায় এবার শরণার্থী স্রোত অনেকটাই স্থিতিশীল৷ তবে সেটি কতদিন থাকবে তা নিয়ে ইউরোপের নীতি নির্ধারকদের দুশ্চিন্তা আছে৷ তালেবান আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর ইউরোপীয় দেশগুলো এমনকি তুরস্কও নতুন করে ভাবনায় পড়েছে৷ ২০১৫ সালে সিরিয়া যুদ্ধের সূত্র ধরে যে শরণার্থী সংকট তৈরি হয়েছিল তার পুনরাবৃত্তি চায় না এই দেশগুলো৷ সেজন্য আগেভাগেই তারা জানিয়ে দিয়েছে, শুধু আফগানিস্তানে পশ্চিমাদের সঙ্গে কাজ করাদেরই আশ্রয় দেয়া হবে, এর বাইরে আর কোন বাড়তি শরণার্থী তারা নিতে রাজি নয়৷ কেউ আফগানিস্তান ছাড়তে বাধ্য হলে তাকে প্রতিবেশী দেশগুলোতেই আশ্রয় নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে৷ 

গত সপ্তাহে এই বিষয়ে বৈঠক করেছেন ইউরোপের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা৷ আফগানদের যাতে দেশটির বাইরে যেতে না হয় সেই মানবিক সহায়তার ব্যবস্থা করা নিয়ে আলাপ করেছেন তারা৷ গত শনিবার ইউরোপীয় কমিশন উরসুলা ফন ডেয়ার লাইয়েন মাদ্রিদে কাবুল থেকে গত কয়েক দিনে আগত আফগানদের একটি অভ্যর্থনা কেন্দ্র পরিদর্শন শেষেও একই ইঙ্গিত দিয়েছেন৷ আফগানিস্তানের জন্য ইইউর চলতি বছরের মানবিক সহায়তা তহবিলের পরিমান বাড়ানোর প্রস্তাব করা হবে বলে জানান তিনি৷

আফগানিস্তান থেকে সম্ভাব্য নতুন শরণার্থী বিষয়ে ইউরোপের দেশেগুলোর মধ্যে কঠোর অবস্থানে থাকা দেশগুলোর একটি অস্ট্রিয়া৷ তারা আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশগুলোতে ডিপোর্টেশন সেন্টার বা অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর কেন্দ্র গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছে৷ এই পরিকল্পনা অনুযায়ী, ইউরোপে আশ্রয় আবেদন বাতিল হওয়া আফগান নাগরিকের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব না হলে এইসব কেন্দ্রে ফেরত পাঠানো হবে৷

আফগানিস্তানের কাবুল বিমান বন্দরে ভিড় করা হাজারো মানুষের প্রতিদিনকার চিত্র ইউরোপের উদ্বেগ বাড়াচ্ছে৷ তালেবান শাসনে যেসব আফগানের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোট সদস্যরা শুধু তাদেরই সেখান থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করছে৷ এমনকি সিরিয়া যুদ্ধের সময়ে শরণার্থী বিষয়ে উদার অবস্থান নেয়া জার্মানিও এবার সতর্ক অবস্থানে রয়েছে৷ বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদ এই নিয়ে প্রকাশ্যেই নিজেদের অবস্থান ব্যক্ত করছেন৷ ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও ম্যার্কেল পরবর্তী চ্যান্সেলর প্রার্থী আরমিন লাশেট তার মধ্যে একজন৷ ২০১৫ সালে যেই অভিবাসী সংকট তৈরি হয়েছিল তার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় গত সপ্তাহে সেই বিষয়ে জোর দিয়েছেন তিনি৷

ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘‘ইউরোপ একা আফগানিস্তান পরিস্থিতির ভার নিতে পারবে না৷ ‘‘আমাদের অবশ্যই অনিয়মিত অভিবাসন স্রোত থেকে নিজেদের রক্ষা করার প্রস্তুতি থাকতে হবে,’’ বলেন তিনি৷

এরমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের দেশগুলো তাদের সঙ্গে কাজ আফগানদের আশ্রয় দেয়ার কিছূ পরিকল্পনা তুলে ধরেছে৷ এর বাইরে আফগানদেরকে নিজেদের দেশে বা পাকিস্তান, ইরানের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোতে কীভাবে সহায়তা করা যায় তা নিয়ে তারা কাজ করছে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্বরাষ্ট্র বিষয়ক কমিশনার ইলভা জোহানসন এই বিষয়ে সবাইকে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার আবেদন জানিয়েছে বলেছেন, ‘‘মানুষ আমাদের সীমান্ত পর্যন্ত আসা অবধি অপেক্ষা করা উচিত হবে না৷’’

অন্যদিকে ইইউ কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট শার্ল মিশেল বলেছেন, ‘‘তৃতীয় দেশের সঙ্গে সমঝোতা করা ইউরোপীয় ইউনিয়নে আমাদের এখন আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে৷ আমাদের নতুন কৌশল ঠিক করতে হবে যাতে অভিবাসন নিয়ম অনুযায়ী ও সংগতিপূর্ণ উপায়ে হয়৷’’

গ্রিস সরাসরি জানিয়ে দিয়েছে তারা ছয় বছর আগের পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি হতে দিবে না৷ দেশটির অভিবাসনমন্ত্রী নটিস মিটারাখি বলেছের, গ্রিসকে তারা ইউরোপের অনিয়মিত অভিবাসনের প্রবেশ দুয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে দিবেন না৷ তার মতে, তুরস্কই বরং আফগানিস্তানের জন্য নিরাপদ৷

এমন মন্তব্যে যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোয়ান৷ এরিমধ্যে দেশটি ৩৬ লাখ সিরিয়ানসহ আরো কয়েক লাখ আফ্রিকান শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে৷ গ্রিসের কথার প্রতিক্রিয়ায় এরদোয়ান তাদেরকে ইউরোপে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য পাঠিয়ে দিবেন বলে হুমকি দিয়েছেন৷ ‘‘ইউরোপের (অভিবাসনপ্রত্যাশী) শরণার্থীদের গুদামঘর হয়ে থাকার কোন দায়, কর্তব্য বা বাধ্যবাধকতা তুরস্কের নেই,’’ বলেন, তুর্কি প্রেসিডেন্ট৷ যদিও এরদোয়ান আফগানিস্তান থেকে অভিবাসন বিষয়ে শুক্রবার গ্রিক প্রধানমন্ত্রী ও ইরানের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন৷

আফগানিস্তান থেকে সম্ভাব্য অভিবাসী স্রোত নিয়ে ইউরোপ উদ্বিগ্ন হলেও অভিবাসন নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর কাছে সীমান্তে বড় ধরনের যাতায়তের কোন তথ্য এখনই নেই৷ তুরস্ক কর্তৃপক্ষ চলতি বছর দেশটিতে অবৈধ উপায়ে প্রবেশ করা ৩৫ হাজার আফগানকে বাধা দিয়েছে৷ ২০২০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৫০ হাজার৷ আর ২০১৯ সালে ছিল দুই লাখ৷ ইউএনএইচসিআরের হিসাবে বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ২৬ লাখ আফগান শরণার্থী রয়েছেন৷ তাদের নব্বই শতাংশ আছেন প্রতিবেশী পাকিস্তান ও ইরানে৷ গত দশ বছরে ছয় লাখ ৩০ হাজার আফগান ইউরোপীয় ইউনিয়নে আশ্রয়ের আবেদন করেছেন৷ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবেদন পড়েছে জার্মানি, হাঙ্গেরি, গ্রিস ও সুইডেনে৷

এফএস/আরআর (এপি)

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন