
২০০২ সালের কথা, ভূমিধস ভোটে বিজয়ী হয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্বে চারদলীয় জোট মাত্রই সরকার গঠন করেছে। অন্যদিকে শুরু হয়েছে ‘ওয়ার অন টেরর’ এর নামে আফগানিস্তান ও ইরাক এ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটোর সামরিক আগ্রাসন। জানুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহে যুক্তরাজ্যের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার সস্ত্রীক বাংলাদেশ সফরে এসে বিশাল আর্থিক সহায়তার লোভ দেখিয়ে আফগানিস্থানে সৈন্য মোতায়েনের জন্য বেগম খালেদা জিয়াকে অনুরোধ করলেন। বেগম খালেদা জিয়া সবিনয়ে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, বাংলাদেশ শুধুমাত্র জাতিসংঘের অধীনে শান্তিরক্ষা মিশনে সৈন্য পাঠাতে পারে, ন্যাটোর অধীনে নয়। তাছাড়া বাংলাদেশ এভাবে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে তাদের জনগণের সিদ্ধান্ত ছাড়া সৈন্য পাঠানোর বিদেশনীতিতে বিশ্বাস করে না।[১,২]
এর পরের ঘটনাটি ঘটে আরো প্রায় আড়াই বছর পরে। ২০০৪ সালের ৫ জুন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল্ড রামসফেল্ড বাংলাদেশ সফরে এলেন। এসেই তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে বৈঠক করলেন এবং ইরাকে বাংলাদেশি সৈন্য পাঠানোর প্রস্তাব উত্থাপন করলেন। ডোনাল্ড রামসফেল্ড এর আগে পাকিস্তানের কাছে সৈন্য চেয়েছিলেন কিন্তু পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফ সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন যে বাংলাদেশ যদি সৈন্য পাঠাতে রাজি হয় কেবলমাত্র তাহলেই পাকিস্তান সৈন্য পাঠাবে। বেগম খালেদা জিয়া রামসফেল্ড প্রস্তাবও সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলেন, একই যুক্তি দেখিয়ে। রামসফেল্ড ওই রাত্রে ঢাকায় থাকলেন। তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সাথে বৈঠক করলেন, বিরোধী দলের সাথে বৈঠক করলেন, সুশীল সমাজের সাথে বৈঠক করলেন। অন্যদিকে মানবাধিকার কর্মীরা ঘটনা আঁচ করতে পেরে হাইকোর্টে রিট করে দিলেন, যাতে বাংলাদেশ ইরাকে সৈন্য পাঠাতে না পারে। রামসফেল্ড দুই দিন ঢাকায় দৌড়াদৌড়ি করেও বেগম খালেদা জিয়ার ‘না’কে ‘হ্যাঁ’ তে পরিবর্তন করতে পারলেন না। আপোষহীন নেত্রী বলে কথা।[৩]
তথাকথিত ‘ওয়ার অন টেরর’ বা সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে ভিনদেশ আগ্রাসনে বাংলাদেশের সেনা পাঠানোয় রাজি না হওয়ায় সন্ত্রাস চেপে বসল বাংলাদেশের বুকে। আওয়ামী লীগ নেতা মির্জা আজমের বোন জামাই শায়খ আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত জেএমবির উত্থান হলো, শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা হলো, বেগম খালেদা জিয়ার চীন সফরের নির্ধারিত দিনে সারাদেশের সবগুলো জেলায় একযোগে বোমা বিস্ফোরণ হল। শেখ হাসিনার উপর হামলার কিছুদিন পর সেই সময় ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক এবং তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা কুলদিপ নায়ার বাংলাদেশ সফরে এসে দুই নেত্রীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। তার সাথে সাক্ষাতকারে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন যে এই হামলাকারীদের সাথে ভারতের যোগাযোগ আছে। কুলদিপ নায়ার সেই অভিযোগকে 'ব্লেইম গেইম' হিসেবে নিয়ে কলাম লিখেছিলেন [৪]। ২০১৪ সালে প্রমান হয়েছে যে ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সৃষ্ট জেএমবি ১৯৯৯ সাল থেকেই ভারতে ঘাটি গেঁড়েছিল। এবং সেই ঘাটি ব্যবহার করেই তারা বিএনপি জোট সরকারকে উচ্ছেদের জন্য ২০০৪-৫ সালে বাংলাদেশে সিরিজ বোমা হামলা চালিয়েছিল [৫]।
বলাবাহুল্য, যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃত্বে পরিচালিত ‘ওয়ার অন টেরর’ এ দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে তাদের হাবিলদার ছিল ভারত।
আফগানিস্থানে আজ যে পুতুল সরকারের পতন ঘটল সেটির ও রূপকার ছিল ভারত।
দীর্ঘ ২০ বছর আফগানিস্থানে শত শত বিলিয়ন ডলার আর হাজার হাজার সৈন্য হারিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন যা বুঝতে পেরেছে এবং যা বুঝতে পেরে তালেবানদের সাথে সমঝোতা করে আফগানিস্তান ছেড়েছে, সেটা বেগম খালেদা জিয়া বুঝতে পেরেছিলেন তাদের দুই দশক আগে।
সত্যের পথে থেকে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে বেগম খালেদা জিয়া ভারত এবং পশ্চিমা বিশ্বের ওয়ার অন টেরর খেলার বলি হয়েছিলেন। ২০০৪ সাল থেকে পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করা হয়েছে। যার পরিণতিতে তাদেরই ছঁকে তৈরি ট্যুইজ'ডে গ্রুপের ষড়যন্ত্রে ১/১১ সৃষ্টি করে বাংলাদেশেও আফগানিস্থানের স্টাইলে একটি জনবিচ্ছিন্ন ফ্যাসিস্ট সরকার বসানো হয়েছে।
মানবাধিকার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন চীনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশি পার্টনার খুঁজে, তখন তাদের অতীত কর্মকান্ড গুলো মনে করিয়ে দেয়া প্রয়োজন।
তাদের মনে করিয়ে দেয়া প্রয়োজন, আফগানিস্থানে সোভিয়েত আগ্রাসনের সময় যে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব আফগান জনগণের বন্ধু ছিল, তারা এখন সেখানে সবচেয়ে বড় ঘৃণার পাত্র; পাকিস্তানের জনগণের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বাংলাদেশেও তাদের এই পরিণতি হওয়ার আগেই তাদেরকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে- ভারতকে দিয়ে বাংলাদেশ শাসনের হাবিলদারী করে তারা বাংলাদেশের আপামর জনগণের ঘৃণার পাত্র হবে? নাকি এই দেশের জনগণের বন্ধু হয়ে থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে এবং জনগণের বাকস্বাধীনতা ও ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করবে।
এ কে এম ওয়াহিদুজ্জামানের ফেসবুক থেকে
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন